মলয় সিংহ, মেজিয়া : গত দু'বছর ধরে করোনার কারণে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল জনজীবন। এবছর করোনার রেশ কাটতেই শিল্পাঞ্চলের মানুষ ভেবেছিল অর্থনীতি কিছুটা হলেও সমৃদ্ধি হবে। কিন্তু এ বছরও শিল্পাঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতিতে মন্দার ছায়া । বাঁকুড়ার মেজিয়া, গঙ্গাজলঘাটি, শালতোড়া শিল্পাঞ্চলে ছোট বড়ো বহু কলকারখানা আজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাজ হারা হয়েছে শিল্পাঞ্চলের প্রায় পঞ্চাশ হাজার শ্রমিক। তাই ধুম ধাম করে বিশ্বকর্মা পুজো এখন অতীত। বাঙালির জীবনে শিল্পকর্মের সৃষ্টিকর্তা বিশ্বকর্মার পুজো বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত হলেও তা আগের জৌলুস হারিয়েছে। শিল্পাঞ্চলের পাথর শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রায় আড়াইশরও বেশি পাথর ক্রাশারের প্রায় তিরিশ হাজারেরও বেশি শ্রমিকরা আজ দু'বছর ধরে জৌলুসহীন পুজো সারছেন। অন্যদিকে সভ্যতার অগ্রগতির সাথে হারিয়ে যাওয়া শালতোড়ার টালি শিল্পের সাথে যুক্ত দু'শো কারখানার প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি শ্রমিক আজ কাজ হারা । তাই
বার্ষিক পরব হিসেবে বিশ্বকর্মা পুজোর আনন্দও যেন ফিকে। কোথায় যেন তাল কেটে গিয়েছে। অর্থনীতির বেহাল দশায় তাই উৎসবেও ভাটা।
তথ্য অনুযায়ী মেজিয়া,গঙ্গাজলঘাটি শিল্পাঞ্চলে আজ ছোট - বড়ো বন্ধ কলকারখানার সংখ্যা দশ থেকে বারোটি যেখানে কাজ হারা হয়েছেন এলাকার প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি শ্রমিক। বন্ধ কারখানায় বন্ধ হয়েছে কর্ম দেবতার পুজো। চালু কারখানাগুলিতে বিশ্বকর্মার আটন পাতা হলেও তা জাগজমক হীন।
উল্লেখ্য দীর্ঘ কয়েক বছর আগেও কামারশালা,ছুতোরের দোকানে, গ্রামের ছোট ছোট সাইকেল গ্যারাজ, রেডিও টিভি মেরামতির দোকান গুলিতে বিশ্বকর্মা পুজো ঘিরে একটা আলাদা উন্মাদনা চোখে পড়তো। কারন বিশ্বকর্মা পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ল মানেই শারদ উৎসবের শুরু হলো বলে মনে করেন অনেকেই। কিন্তু ক্রমেই হারিয়ে গিয়েছে গ্রামবাংলার কামারশালা, ছুতোরের দোকান। চাহিদা না থাকার জন্য বর্তমান প্রজন্মও তাদের পূর্ব পুরুষদের ব্যবসায় থাকতে চায় না। যার জন্য গ্রামের দিকেও বিশ্বকর্মা পুজোর জাঁক কমে গিয়েছে।
গ্রামগঞ্জে এখন বিশ্বকর্মা পূজো মূলত টোটো, অটো ট্রেকার চালকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। টোটো-অটো চালকদের জাঁকজমকপূর্ণ বিশ্বকর্মা পুজোয় কোথাও যেন আসল ছবিটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও লোহার গ্রিল তৈরির কারখানা, রাজমিস্ত্রির বাড়িতে কিংবা গ্রামের দিকে কেবিল অপারেটরদের দোকানে বিশ্বকর্মা পুজো হতে দেখা গিয়েছে। আবার গ্রামের ধানকল, তেল কল, মুড়ি মিলে বিশ্বকর্মা পুজো হতে দেখা গিয়েছে এ বছরও। এছাড়াও সাইকেল, মোটরসাইকেল, বড়গাড়ি সহ বিভিন্ন বাড়িতে কর্মদেবতার আটন পেতেছেন। কিন্তু সবেতেই গা-ছাড়া ভাব।
তবে,অনাড়ম্বর এবং উৎসাহে ভাটার ছবি সবচেয়ে স্পষ্ট শিল্পাঞ্চলে বন্ধ কলকারখানা গুলিতে এবং শালতোড়া, মেজিয়া, গঙ্গাজল ঘাটির পাথর শিল্পগুলিতে। সব জায়গাতেই নম নম করে পুজো সারতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খাদান, ক্রাশার ও কারখানার মালিকরা।
জানা যায় মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের ভিতর একসম দু'শোটিরও বেশি বিশ্বকর্মা পুজো হতো । কিন্তু এখন তা দাঁড়িয়েছে পঞ্চাশ থেকে ষাটে। তারাও আজ নম নম করেই পুজো সারছেন।
বিশ্বকর্মা পুজোয় মন ভালো নেই কাঁটা মালিকদের। কলকারখানা বন্ধ থাকায় বাজারে কমেছে ওজন করার চাহিদা। বন্ধ হয়েছে এলাকার অনেক কাঁটা । বর্তমানে কোনক্রমে টিকে আছে বেশ কটা। এক ওজন ব্যবসায়ী জানান বছর কয়েক আগেও এই দোকানগুলিতে ধুমধাম করে বিশ্বকর্মা পুজো হতো। কর্মচারীদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও থাকত। এখন তো ব্যবসা টিকিয়ে রাখায় বিরাট চ্যালেঞ্জ ! ফলে বিশ্বকর্মা পুজোয় আরম্বর করবো কিভাবে? পুজো ঘিরে উৎসাহ হারিয়েছে শিল্পাঞ্চলের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরাও । মধ্যা কথা শিল্পাঞ্চলে এবছর অনাড়ম্বেই বিশ্বকর্মার আসন পাতা।